Sunday 20 December 2015

প্রথম চুম্বন – First Kiss- Clarice Lispector

‘প্রথম চুম্বন’ ক্লারিস লিসপেক্তরের ইংরেজিতে অনূদিত ‘ফার্স্ট কিস’ গল্পের অনুবাদ। গল্পটি ইংরেজিতে অনুবাদ করেছেন রেচেল ক্ল্যান এবং ২০১৩ সালে ‘বম্ব’ ম্যাগাজিনে প্রকাশিত হয়।

লেখক পরিচিতি : বিংশ শতাব্দীর পর্তুগিজ ভাষার অন্যতম শ্রেষ্ঠ কথাসাহিত্যিক এবং ফ্রাঞ্জ কাফকার পরবর্তী উল্লেখযোগ্য ইহুদি লেখক হিসেবে স্বীকৃত ব্রাজিলের নারী সাহিত্যিক ক্লারিস লিসপেক্তর। তিনি ১৯২০ সালের ১০ ডিসেম্বর ইউক্রেনের পশ্চিমাঞ্চল এলাকার চেচেলনিক শহরে এক সম্ভ্রান্ত ইহুদি পরিবারে জন্মগ্রহণ করেন। তিনি দু-বছর বয়সে পরিবারের সঙ্গে ব্রাজিলের অভিবাসী হন। মাত্র ২৩ বছর বয়সে তিনি প্রথম উপন্যাস ‘নিয়ার টু দ্য ওয়াইল্ড হার্ট’ (Near to Wild Heart) প্রকাশ করেন এবং ‘গ্রাসা আরানহা’ পুরস্কার অর্জন করেন।  তিনি এডগার এলান পো এবং অস্কার ওয়াইল্ডের লেখা পর্তুগিজ ভাষায় অনুবাদ করেন। তাঁকে ‘নারী চেকভ’ হিসেবে আখ্যায়িত করা হয়। তিনি ১৯৭৭ সালের ৯ ডিসেম্বর ওভারিয়ান ক্যানসারে (Ovarian Cancer) মৃত্যুবরণ করেন।

প্রথম চুম্বন – First Kiss



ওরা দুজন পরস্পর কথা বলার চেয়ে বিড়বিড় করে বেশি। সম্প্রতি ছেলে এবং মেয়েটির মধ্যে প্রেমের সম্পর্ক গড়ে উঠেছে। তাই এই মুহূর্তে ওরা দুজনেই বেশ ফুরফুরে মেজাজে আছে। এক কথায় ওরা উভয়েই প্রেমের উত্তাল সাগরে রীতিমতো হাবুডুবু খাচ্ছে। প্রেমের সঙ্গে কী জড়িয়ে থাকে? ঈর্ষা।


—ঠিক আছে। আমি তোমাকে বিশ্বাস করি, আমিই তোমার জীবনে প্রথম প্রেম। এই বিশ্বাস আমাকে সুখী করে তুলেছে। কিন্তু সত্যি করে বলো তো, আমাকে চুমু খাওয়ার আগে তুমি অন্য কোনো নারীকে চুমু খাওনি? মেয়েটি সরাসরি প্রশ্ন করে।


ছেলেটির কাছে প্রশ্নটি খুবই সহজ এবং সে উত্তরও জানে।


—হ্যাঁ, আমি আগে একজন মহিলাকে চুম্বন করেছিলাম।


—কে ছিল? দুঃখ ভারাক্রান্ত মনে মেয়েটি পুনরায় জিজ্ঞেস করে।


ছেলেটি স্বাভাবিক গলায় বলার চেষ্টা করে, কিন্তু সে জানে না কীভাবে তার বলা উচিত ছিল।


আঁকাবাঁকা পাহাড়ি রাস্তা বেয়ে ট্যুর বাস ধীরগতিতে উপরে উঠতে থাকে। বাসের ভেতর ছেলেটির আশপাশে অন্যান্য ছেলেমেয়েরা খোশগল্পে মশগুল। খোলা জানালা দিয়ে হালকা শীতল বাতাস এসে তার চোখেমুখে আলতো পরশ বুলিয়ে দিচ্ছে এবং চুলের ওপর ঢেউ খেলে খোলা হাওয়ায় হারিয়ে যাচ্ছে। তার কাছে মনে হয়, যেন কোনো মা তার নরম আঙুল দিয়ে সন্তানের চুলে বিলি কেটে দিচ্ছেন। বেশির ভাগ সময় ছেলেটি চুপচাপ থাকে। তখন সে কিছুই ভাবে না, শুধু মুহূর্তগুলো অনুভব করার চেষ্টা করে এবং মনের মধ্যে সে একধরনের সুখের অনুভূতি উপলব্ধি করে। বন্ধুবান্ধবদের হৈ-হুল্লোড়ের মধ্যে মনোযোগের সঙ্গে ভালোলাগার সূক্ষ অনুভূতি উপলব্ধি করা তার কছে খুবই কঠিন কাজ বলে মনে হয়।


ছেলেটির ভেতর জগতে তেষ্টার ইচ্ছেটা প্রবল হতে থাকে। একসময় সে বন্ধুবান্ধবের সঙ্গে কৌতুক করে, এমনকি কণ্ঠস্বর উপরে তুলে কথা বলে, যা মোটরের ঘর্ঘর শব্দকে ছাপিয়ে যায় এবং হাসি-ঠাট্টায় মশগুল হয়। কখনো সে চোখের পাতা বন্ধ করে সুখানুভূতির পরশ উপলব্ধি করে। সে ভেবে পায়নি, কেমন করে তার গলা শুকিয়ে কারবালা হয়ে গিয়েছিল।


না, গলা ভেজানোর জন্য পানির প্রয়োজনীয়তার কোনো আভাস-ঈঙ্গিত ছিল না। তবে তার তৃষ্ণা নিবারণের সমাধান ছিল মুখের ভেতর লালা জমানো এবং সে-ই কাজই সে করেছে। উত্তপ্ত মুখের ভেতর লালা জমার পর সে ধীরে ধীরে গলধঃকরণ করে। তারপর একবার নয়, বরং বারবার একই কাজ করেছে। তার মুখের লালা বেশ গরম ছিল এবং সেই গরম লালা তার তেষ্টা মেটাতে পারেনি। তার প্রচণ্ড তৃষ্ণা যেন দেহের চেয়ে বড় আকারের রূপ ধারণ করেছিল এবং সেই তৃষ্ণা ক্রমশ তার সমস্ত শরীরে ছড়িয়ে পড়েছিল।


যদিও কিছুক্ষণ আগে বাইরের বাতাস ছিল মনোরম, কিন্তু এখন মাথার ওপর গনগনে সূর্য। আশপাশের হাওয়া শুষ্ক। প্রচণ্ড ধৈর্য নিয়ে সে মুখের ভেতর যতটুকু লালা জমিয়েছিল, শুষ্ক বাতাস তার নাসারন্ধ্রে পৌঁছার সঙ্গে সঙ্গে তা নিমিষে শুকিয়ে যায়।


ছেলেটি যদি নাক বন্ধ করে এবং মুখ দিয়ে মরুভূমির তপ্ত বাতাস বুকের ভেতর সামান্য টেনে নেয়, তাহলে?


তবুও সে কয়েক সেকেন্ড সেই কাজ করার চেষ্টা করে। তার দম বন্ধ হয়ে আসে। সমস্যার একমাত্র সমাধান হলো অপেক্ষা করা, শুধুই অপেক্ষা করা। হয়তো কয়েক মিনিট মাত্র, হয়তো কয়েক ঘণ্টা। ইতিমধ্যে তার তৃষ্ণা এত বেশি লেগেছে যে, মনে হয় বছরের পর বছর ধরে তা জমে স্তূপ হয়েছে।


ছেলেটি জানে না কেমন করে এবং কেন? কিন্তু তার মনে হয় কাছাকাছি কোথাও সে পানির উপস্থিতি টের পেয়েছে এবং বড় বড় চোখ করে সে জানালার বাইরে রাস্তার উল্টোদিকে ঝোপঝাড়ের আড়ালে পানি খুঁজতে থাকে।


তার মনের গভীরে লুকিয়ে থাকা বন্য পশুর ধারণা মোটেও ভুল হয়নি। রাস্তার অপ্রত্যাশিত বাঁকের পরেই ঝোপঝাড়ের পেছনে সে একটা ঝরনা দেখতে পেল। সেই ঝরনা থেকে পানি পড়ছে।


ঝরনার কাছে এসে বাস থামে। বাসের আরোহী সবাই প্রচণ্ড তৃষ্ণার্ত। ছেলেটি দৌড়ে সবার আগে ঝরনার কাছে গিয়ে পৌঁছায়।


তার চোখের পাতা বন্ধ। কিন্তু যেখান দিয়ে পানি পড়ছিল, সে সেই জায়গায় ঠোঁট দুটি সামান্য ফাঁক করে আলতো ভাবে রাখে। প্রথম ঢোক গেলার সময় গলা বেয়ে নিচে নেমে পানি তার পাকস্থলিতে গিয়ে পৌঁছায় এবং পরমুহূর্তে সে পরম শান্তি অনুভব করে।


তারপর ছেলেটি পরিতৃপ্তির সঙ্গে আরও পানি পান করে। একসময় সে ভাবে, পুনরায় সে জীবন ফিরে পেয়েছে। ধীরে ধীরে তার ক্লান্ত চোখের পাতা খুলতে থাকে।


একসময় ছেলেটি চোখের পাতা সম্পূর্ণ খোলে এবং তাকিয়ে দেখে তার মুখের ঠিক ডান পাশেই একটা পাথরের মূর্তি। মূর্তির চোখ দুটি তার দিকেই স্থির দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে। মূর্তিটি একজন নারীর। সেই নারীমূর্তির মুখ দিয়েই পানি বের হচ্ছে। তার মনে পড়ে, সত্যি কথা বলতে কি, প্রথম চুমুক পানি পান করার সময় ঝরনার ঠাণ্ডা পানির চেয়েও হিমশীতল কোনো কিছুর সঙ্গে তার ঠোঁট দুটির স্পর্শ লেগেছিল। তখনই সে বুঝতে পেরেছিল যে, পাথরের নারীমূর্তির ঠোঁটের সঙ্গে তার ঠোঁটের ছোঁয়া লেগেছিল। মূর্তির ঠোঁট থেকে এক ঝলক বিদ্যুত্-তরঙ্গ এসে যেন তার ঠোঁট কাঁপিয়ে দিয়েছিল। তারপর সেই বিদ্যুত্-তরঙ্গ এক ঠোঁট থেকে অন্য ঠোঁটে ছোটাছুটি করেছিল।


নিজের মূর্খতার জন্য ছেলেটি তাত্ক্ষণিকভাবে হতভম্ব হয়। আপনমনে ভাবে, সে হয়তো কোনো গোপন প্রণয়ে জড়িয়ে যাচ্ছে। কিন্তু এ-তো সেই নারী নয়, যার কাছ থেকে অমৃত ধারা বেরিয়ে আসছে—যা জীবনকে সজীব করে তোলে। একসময় সে নিরাভরণ নারীমূর্তির দিকে ফ্যালফ্যাল করে তাকিয়ে থাকে।


পাথরের নারীমূর্তির ঠোঁটে সে চুমু খেয়েছে।


ছেলেটি সারা শরীরে একধরনের অদৃশ্য পুলক শিহরণ অনুভব করে, যা তার নিজের ভেতরেই সৃষ্টি হয়েছিল। এক অচেনা অনুভূতিতে তার দেহের শিরা-উপশিরার মধ্যে প্রবাহিত রক্তকণা টগবগ করতে থাকে। উত্তেজনায় তার মুখ যেন একখণ্ড জ্বলন্ত কয়লা।


ছেলেটি এক কদম পেছনে, নাকি সম্মুখে গিয়েছিল, তার কিছুই মনে নেই। সেই সময় সে রীতিমতো উত্তেজিত এবং আশ্চর্যান্বিত। তবে সে বুঝতে পেরেছিল যে, আগে তার শরীরের যে অংশটুকু নেতিয়ে থাকত, ওটাও তুমুল উত্তেজনায় শক্ত হয়ে গেছে। তার জীবনে এ ধরনের ঘটনা আগে কখনোই ঘটেনি।


ছেলেটি ভিড়ের মধ্যে দাঁড়িয়ে একাকী ঘামতে থাকে। তার বুকের ভেতর ধুকপুকানির শব্দ আরও দ্রুত হয়। সেই সময় জীবনটা তার কাছে আনকোরা এবং অন্যরকম মনে হয়েছে, যা সে শুধু তখনই উপলব্ধি করতে পেরেছে। দোদুল্যমান সেই পরিস্থিতিতে সে সম্পূর্ণ কিংকর্তব্যবিমূঢ়।


ছেলেটির গভীর অনুভব থেকে একসময় সত্যটা বেরিয়ে আসে। তার চোখেমুখে এক অজানা ভয়ের চিহ্ন ফুটে ওঠে এবং একই সঙ্গে এক অদ্ভুত অনুভূতির উজ্জ্বল রশ্মি ছড়িয়ে পড়ে। আগে সে এই অন্যরকম অনুভূতি কখনোই অনুভব করেনি। সে … সে একজন পরিপূর্ণ পুরুষে রূপান্তরিত হয়েছে।

No comments:

Post a Comment